শুক্রবার ১৭ অক্টোবর ২০২৫ - ১০:০৮
ইসলামের দৃষ্টিতে সুশৃঙ্খল ঘুম: কেবল শরীরের বিশ্রাম নয়, আত্মার প্রশান্তির দরজা

ভালো, নিয়মিত ও সুশৃঙ্খল ঘুম মানবজীবনের মানসিক প্রশান্তি ও শারীরিক কর্মশক্তির প্রধান ভিত্তি। ঘুম কেবল ক্লান্তি দূর করে না, এটি আত্মার গভীরে শান্তি, স্থিরতা ও আনন্দের উৎস তৈরি করে। ইসলামী শিক্ষায় ঘুমকে শুধুমাত্র বিশ্রাম নয়, বরং আত্মিক ভারসাম্য ও আল্লাহর রহমতের নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি’র প্রতিবেদনে জানানো হয়—মাজানদারান প্রদেশের হাওজায়ে ইলমিয়ার বিশিষ্ট আলেম ও গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম হোসেইন তাগিপুর “ইসলামের দৃষ্টিতে আনন্দ ও প্রফুল্লতা সৃষ্টির উপায়” শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনায় অংশ নেন। তাঁর বক্তব্যসমূহ “আনন্দের সূত্র” নামে প্রকাশিত হচ্ছে, যেখানে ঘুমের ইসলামী ও বৈজ্ঞানিক দিক তুলে ধরা হয়েছে।

হুজ্জাতুল ইসলাম তাগিপুর বলেন, “সঠিক ঘুম আল্লাহর পক্ষ থেকে এক রহমত, যা আত্মাকে স্থিরতা দেয় এবং মনকে পবিত্র করে। ইসলামী শরিয়ত আমাদের শিখিয়েছে কবে, কিভাবে এবং কতটুকু ঘুমানো উচিত।”

কুরআনের দৃষ্টিতে ঘুম: আল্লাহর এক নিদর্শন
পবিত্র কুরআনে, সূরা আল-আম্বিয়ায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, “وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا”
অর্থাৎ, “আমি তোমাদের ঘুমকে করেছি বিশ্রামের উপায়।”

এই আয়াত স্পষ্টভাবে জানায়—ঘুম কোনো সাধারণ জৈবিক প্রয়োজন নয়; এটি আল্লাহর এক বিশেষ নিয়ামত, যা মানুষকে মানসিক প্রশান্তি ও আত্মিক স্থিতি প্রদান করে। কিন্তু যখন মানুষ ঘুমের স্বাভাবিক নিয়ম ভঙ্গ করে, তখন তা দেহের পাশাপাশি মনেরও অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

দুপুরের স্বল্পক্ষণিক ঘুম (কায়লুলা): নববী সুন্নতের অংশ
ইসলামে কায়লুলা বা দুপুরের সংক্ষিপ্ত ঘুমের প্রতি বিশেষ উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে—এই স্বল্প বিশ্রাম শরীরের ক্লান্তি দূর করে এবং মস্তিষ্ককে পুনরুজ্জীবিত করে। সাধারণত ১০ থেকে ৪৫ মিনিটের এই ঘুম বিকেলের দীর্ঘ ঘুমের বিপরীত; দীর্ঘ ঘুম সময়ের অপচয় এবং শরীরের অলসতা সৃষ্টি করে।

ধর্মীয় শিক্ষায় আরও বলা হয়েছে—মাগরিব ও ফজরের পর ঘুমানো অনুচিত, কিন্তু ইশার নামাজের পর ঘুমানো সুপারিশকৃত। এটি শরীরের প্রাকৃতিক ঘড়িকে সঠিক রাখে এবং ভোরবেলার ইবাদতের প্রস্তুতি সহজ করে।

অতিরিক্ত ঘুম: অলসতা ও মানসিক ভারসাম্যহীনতার উৎস
রাসূলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করে বলেছেন— “অতিরিক্ত ঘুম, অতিভোজন, অতিবাক্য ও প্রবৃত্তির অনুসরণ—এগুলো মানুষের কষ্ট ও বিপদের কারণ।” (সূত্র:মাফাতিহুল হায়াত)

ইসলাম চায়, মানুষ ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন করুক। মিতাহার, নিয়মিত শরীরচর্চা ও পরিমিত ঘুম—এই তিনটি অভ্যাসই সুস্থ ও আনন্দময় জীবনের ভিত্তি।

ঘুমের ধরন: ইসলামী ঐতিহ্যের ব্যাখ্যা
ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী ঘুমের চারটি ধরন রয়েছে—
▫️নবীগণ (আ.) পিঠের ওপর শোয়া অবস্থায়   ঘুমাতেন।

▫️মুমিনেরা ডান কাতে ঘুমান।

▫️কাফের ও মুনাফিকরা বাঁ কাতে ঘুমায়।

▫️আর শয়তানরা পেটের ওপর শোয়।

তাই ইসলাম পরামর্শ দেয়—ডান কাতে ঘুমানোই সর্বোত্তম। এটি হৃদযন্ত্রের চাপ কমায়, রক্তসঞ্চালন সহজ করে এবং মানসিক প্রশান্তি বাড়ায়।

ঘুমের আগে শারীরিক ও আত্মিক প্রস্তুতি
ইসলামী শিক্ষায় ঘুমের আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যা শারীরিক স্বাস্থ্য ও আত্মিক পবিত্রতা রক্ষায় সহায়ক।
এসব হলো—
• অতিরিক্ত খাওয়ার পর ঘুমানো নিষেধ।

• ঘুমানোর আগে টয়লেটে যাওয়া।

• অজু করে ঘুমানো।

• কিবলামুখী হয়ে শোয়া।

ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নির্দেশনাগুলো আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। অজু শরীরকে শিথিল করে, হজমে সহায়তা করে এবং স্নায়ুকে শান্ত রাখে।

কিবলামুখী হয়ে ঘুমানো: আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি
আয়াতুল্লাহ হাসানজাদে আমোলি (রহ.) বলেন— “বিশ্বের চৌম্বক ক্ষেত্র উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। এই প্রাকৃতিক প্রবাহের বিপরীতে ঘুমালে শরীরের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে। তাই ইসলামে কিবলামুখী হয়ে ঘুমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।”

এই বিষয়ে দুটি মত রয়েছে—

১. কেউ বলেন, পা কিবলার দিকে রেখে ঘুমানো উচিত।

২. আবার কেউ বলেন, মাথা পশ্চিমে ও পা পূর্বে, অর্থাৎ মৃতদেহের মতো কবরে রাখা ভঙ্গিতে ঘুমানোই উত্তম।

প্রখ্যাত আলেম হুজ্জাতুল ইসলাম ফাতেমিনিয়া (রহ.) দ্বিতীয় মতকে উত্তম বলেছেন। তাঁর মতে, এই ভঙ্গি শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং মনকে প্রশান্ত রাখে।

ঘুমের আগে আধ্যাত্মিক আমল: মন ও আত্মার পরিচ্ছন্নতা
ইসলামী নির্দেশনা অনুযায়ী ঘুমের আগে কিছু আমল করলে মানুষ আত্মিক শান্তি পায় এবং বরকতময় ঘুম লাভ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

•তিনবার সূরা ইখলাস পাঠ

•নবীজী (সা.)-এর ওপর দরুদ পাঠ

•মুমিনদের জন্য ইস্তেগফার

•এবং তাসবিহাতুল আরবা (সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার) পাঠ।

হাদীসে এসেছে—এই আমলগুলো কুরআন খতম, হজ্ব ও ওমরার সমান সওয়াব এনে দেয় এবং মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে।

ঘুম: এক আত্মিক শিক্ষালয়
আলেমগণ বলেন—ঘুম হলো একপ্রকার “আধ্যাত্মিক বিশ্ববিদ্যালয়”, যেখানে মানুষ শিখে ধৈর্য, ভারসাম্য ও আত্ম-অনুসন্ধান।

অজু করে ঘুমানো, কুরআন তেলাওয়াত করা, তাসবিহ পাঠ, তাহাজ্জুদের প্রস্তুতি নেওয়া এবং সেহরির সময়ের প্রশান্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়া—এই অভ্যাসগুলো আত্মাকে জাগ্রত করে এবং মনকে আলোকিত রাখে।

অভিজ্ঞতার আলোকে
বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে—যারা ইসলামী ঘুমের এই নিয়মগুলো মেনে চলেন, তাঁদের সকাল শুরু হয় শান্তি, উদ্যম ও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে। তাঁরা মানসিকভাবে স্থিতিশীল, শারীরিকভাবে সক্রিয় এবং আত্মিকভাবে পরিতৃপ্ত থাকেন।

ঘুম কেবল শরীরের বিশ্রাম নয়—এটি আত্মারও প্রশান্তি ও আত্মসংযমের মাধ্যম। ইসলাম মানুষকে শেখায়, জীবনের প্রতিটি কাজে শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য রক্ষা করতে। সুশৃঙ্খল ঘুম সেই ভারসাম্যেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা মানুষের জীবনকে করে তোলে প্রশান্ত, প্রফুল্ল ও আলোকিত।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha